জীবনের গল্প আর সেলফি

বনের রাজা টারজান আর কুরবানীর হাটে আমাদের ভাইজান। দুইজনের তুলনা চলে না। বন্য সিংহ যেমন টারজানের কাছে আসলে পরাস্ত তেমনি কুরবানী হাটে গরুগুলো ভাইজানের কাছে নাদাবস্তু।ভুল বলা হবে যে কোন সময়ে যে কোন তেজী গরুও তার কাছে হার মানে এ জন্য এলাকায় কোন গরু কেনা কাটার দরকার হলে সকলে তার নিকট শরণাপন্ন হয়। ভাইজান কেবল গরু বাগে আনতে পারে তা নয় ভালো গরু চেনা কসাইয়ের কাজ অনায়াসে তিনি করতে পারেন। তবে তার যত সব সমস্যা হল ছাগল নিয়ে। ছাগলের গন্ধ একফুটোও সহ্য হয় না। তার উপর তিড়িং বিড়িং চলনে তার নাকি গা জ্বলে।ডাক শুনলে তার নাকি হার্টে সমস্যা হয়। শুনা যায় প্রাচীন বহু বড় বড় বীর বিরাট সাহস থাকার পরও ছোট্ট ছোট্ট কিছু প্রাণীকে প্রচন্ড ভয় পেতেন।

এক সপ্তাহ পরেই কুরবানী।তাই সকলে ব্যস্ত গরু,ছাগল কেনার ব্যাপারে। ছাগল কম মানুষই কিনে। হয়তো শখ-ইচ্ছা,পছন্দ নতুবা ঠেকায় না পড়লে কেউ কিনে না। তো গরু নিয়ে সকলে চরম তুড়ে। পাড়ার ছোকরা পোলাপাইন নতুন কিছু পাইলেই হয়। একে তো পড়াশুনা করে না সারাদিন টু টু ঘোরা ফেরা করে আর ফেসবুক নিয়ে থাকে। নিজের স্ট্যাটাস ও প্রোফাইল পিকসে লাইক নিয়ে প্রতিযোগিতার অন্ত থাকে না। এবার হঠাৎ কার মাথায় জানি আইডিয়া এল, "সেলফি ও গরু" নিয়ে ছবি তোলার উত্তেজক প্রতিয়োগিতা। সকলে যত তাড়াতাড়ি পারে গরু কেনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। এত পাগল হল যে সেলফি নিয়ে পাড়ায় একটা কবিতা রটে গেল
- "চাই নিজ সেলফিময় গরু, এতো কেবল কুরবানীর শুরু"
 
গরু কেনার ব্যাপারে চামড়া এবং দৈহিক আকার ও সৌন্দর্যের প্রতি নজর দিল। বাবাকে পটিয়ে ফাটিয়ে সুন্দর সুন্দর দেখে গরু কিনে ফেলল। হাটে পড়ে রইল অনাঙ্কিত সব গরু। ফলে শেষ হাটে মানুষ কিছুটা বাধ্য হয়ে যা পেল তাই কিনে নিল। পাশের বাসার রাজনদের গরুটা পুরা সাদা। সামিদেরটা সাদাকালো মিশ্রিত, ফাহিমদেরটা পুরাই কালো অন্ধকারে কিছু মানুষ নাকি ধাক্কাও খেয়েছে। শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতন অবস্থা। ইদানীং ভাইজানকে কেউ আর ডাকে না। তিনি কিছুটা উদাস মনে দুঃখ দুঃখ অবস্থায় ঘোরাঘুরি করেন। ফাহিমের বাসা থেকে কুরবানীর কয়েকদিন আগে -
"অঙ্ক কর"
"কিসের অঙ্ক?"
" তোর না কুরবানীর পর ম্যাথ পরীক্ষা?"
"হ্যাঁ তাতে কি?"
" ভাব দেখ যেন সব পারে। অঙ্ক সবগুলান পারস?"
একটি ক্যালকুলাসের অঙ্ক দেখিয়ে দিয়ে," দেখি এটা কর তো। পারস কিনা দেখি?"
"না না এখন করবো না।আমার এখন অঙ্ক করার মুড নাই"
আকাশ থেকে পড়ল ফাহিমের বাবা,"অঙ্ক করতে আবার মুড লাগে নাকি? তোদের বয়সে কি আমি অঙ্ক করি নাই। আমারে পড়াইতে আসছস। এ পড়া আমি তোর জন্মের আগে পড়ে আইছি। আমার সঙ্গে ঠালটি বালটি চলত ন বুঝছস?"

পাশের বিল্ডিং এর নিচে বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সামি। নাফিস কানে এসে কি যেন বলল। সামি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। নাফিস চুপিচুপি দড়ি দিয়ে বাধাঁ গরুর কাছে এগিয়ে গেল।ওদের শয়তানিটা এইবার বোঝা গেল। ভাইজান পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন ভারাক্রান্ত মনে। তিনি হঠাৎ দেখলেন গরুর লেজ ধরে টান দিতে যাচ্ছে নাফিস। কিছু বুঝে উঠার আগেই গরুটা তার বাম পাশের পিছনের পা দিয়ে সজোরে লাথি মারল তার পেটে।
ককিয়ে উঠল সে - "ওমাগো!!!"
ভাইজান দৌড়ে আসলেন। তিনি তাড়াতাড়ি নাফিসের নাক টিপে ধরলেন।
"একি করেন ভাইজান" সামি বলে উঠলেন।
"আরে তোরা জানস না হঠাৎ ব্যথা পেলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়। এ সময় নাক টিপে ধরে মুখ দিয়ে প্রশ্বাস নিঃশ্বাস নিলে আরাম পাওয়া যায়,"
- ভাইজানের বিজ্ঞ জবাব। পাঁচ-ছয় মিনিট পর নাফিসকে সুস্থ মনে হল।তাকে সামান্য পানি খাওয়ানো হল। ভাইজান গরুর সামনে গিয়ে ৩৬ ওয়াটের একটা পেঁচার হাসি দিল। তারপর গরুর নাক-শিং মাঝখানে কপালের জায়গায় সামান্য হাত বুলিয়ে আলতোভাবে চুলকিয়ে দিল। মনে হল গরুটি বেশ খুশি। গরুটি তাকে পছন্দ করেছে বোধদয়।


হঠাৎ করে কুরবানীর তিন দিন আগে আবির্ভাব হল রহস্যময়ী এক গরুর অবয়ব। পাড়ার সকল বড়-ছোটরা এখন সন্ধ্যার পর বের হতে ভয় পাই। গুজব রটল এটা নাকি গো-ভূত। ভূতের নাম শুনে নানা ওঝা এসে হাজির।এ যুগে এটাও হতে পারে জানা ছিল না আগে।বোধদয় গো-ভূত খেঁপে গেল।কারণ এরপর একে একে পাগল হতে থাকে পাড়ার সুন্দর সুন্দর গরুগুলো।প্রথমে সামিদেরটা তারপর,ফাহিম শেষে রাজনদেরটা।সকলে অবাক হয়।কেউ কেউ বলছে রাতে নাকি তারা এক ধরনের আওয়াজ শুনে তারপরই নাকি গরু পাগলের মতন হয়ে যায়। পাড়ায় গবেষণা চলতে শুরু করল কেন গরুগুলো পাগল হয়ে যাচ্ছে। আব্বুরা মিলে তদন্ত করতে শুরু করল। বাসায় বাসায় দেখা গেল বাবারা দুপুর পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে। আম্মুরা ন্যাকা বলে নাক সিটকিয়ে চলে যায়। রাতে শুরু হয় দারোয়ানোর মত বাবাদের দায়িত্ব। কিছুটা কমে গেল বলে মনে হল। কিন্তু সকলে পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারেনি। কয়েকজন দারোয়ান রাখা হল। এত সব কিছু হল দুইদিনের ভিতরে। তৃতীয় দিন আবার হলো। তবে এবার একই সাথে তিন স্থানে। বুঝা গেল এই চক্র কিছুটা বড়গোচের।ফলে ঘাবড়ে গেল বাবাসমাজ। তারা কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ল। না পারছে কিছু করতে, না পারছে না করে থাকতে।পুরাই দোটানা অবস্থায় পড়েছে।

অবশেষে ধরা পড়ল আসল অপরাধী। আসল অপরাধী পাড়ার পোলাপাইন। তারা কেন জানি দিনের বেলা বেছে না নিয়ে রাতের বেলাকে সেলফি তুলার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেছে কেউ ঠিক বুঝল না। বিষয়টা ধরা পড়ে যখন সামির আব্বু খেয়াল করল রাতের বেলা সামি ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত। কোথায় যেন যাবে? তিনি কিছুটা অনুসন্ধিৎসু হলেন। ছেলের পিছন পিছন গিয়ে দেখতে চাইলেন তার ছেলের কীর্তি। দেখেও ফেললেন। প্রথমে তারা চুপিচুপি স্পটে উপস্থিত হয়। তারপর গরুকে সুন্দর মত একটু নাড়িয়ে একটা পোজ দেয়ার মতন ব্যবস্থা করে। তারপর ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইট অন করে। এরপর একটা বান্দর হাসি দিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়। প্রথম প্রথম সবাই নিজ নিজ গরুর সাথে ছবি তুলেছে। কিন্তু যখন দেখে তোলার মত আর নেই তখন তারা একটি শর্ত প্রস্তাব করে।সবাই এবার পালাবদল করে ছবি উঠাবে।এভাবে করতে গিয়ে প্রথমত গরুর চোখে ফ্ল্যাশলাইট পড়ত দ্বিতীয়ত সারা রাত গরুকে জ্বালাত। ফলে গরুটা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও বলা যেতে পারে জোর করেই এরা পাগল বানিয়ে ছাড়ত। শুরুতে ক্যামেরার সাউন্ড অন ছিল তাই আওয়াজ হত। পরে তারা গ্রুপ মিটিং করে ডিফেক্টগুলো আইডেন্টিফাই করে সেগুলো সলভ করে। বাবাসমাজ নিজ পোলাপাইনের এমন শয়তানিতে যথেষ্ট বিরক্ত হল। নানা বকাঝকা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। ধমকি দিলেন আর যদি এমন হয় তো এবার ঈদে তাদের উপর শনির দশা হবে। অর্থাৎ মোবাইলগুলো জব্দ করা হবে।সবাই চুপচাপ। কেউ কেউ মনে মনে হাসি দিল কেউবা কিছুটা ভয় পেল।

যথারীতি সবকিছু আগের মত স্বাভাবিক হল। সকলে কুরবানীর প্রস্তুতি করতে লাগল পুরোদমে। পাড়ার পাশে এক বস্তিতে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় বস্তির সামনে এক পুুরুষের উদয় হল। হাতে কিছু একটা দেখা গেল। হঠাৎ অস্থির,অধীর আগ্রহী এক কন্ঠ বলে উঠল -
"গরু আনছ,ভাইজান?"
"নারে ভাই" - ক্ষুধার্ত কচি মুখটা আরো মলিন হয়ে গেল। মাথাটা নিচু করে উঠোনের উচুঁতে বসে থাকা সাত বছরের জামিল ঘরে ঢুকে পড়ল। ভাইজান আজ ভেঙ্গে পরলেন। আজ সকালে ঘর বের হওয়ার সময় তার ছোট ভাই জামিল বলেছিল কুরবানীর গরু কিনে আনতে। জানে পারবে না তবুও ওকে না বলতে পারে নি। ঠিক করেছিল একটা ছাগল কিনে আনবে। এটা দেখেই হয়তো তার গরুর চাহিদা মিটবে কিন্তু তাও করতে পারেনি। নিজের ক্ষমতাও উপর নিজেই রাগ হচ্ছে। কেমন ভাই সে তার ভাইকে সামান্য গরু তো দূরের কথা একটা ছোট্ট ছাগলও এনে দিতে পারে না। চুলার উপর রান্না করা সামান্য খাবারটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ভাইজান আর জামিল। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় সেদিন রাতে তারা দুইজন মিলে একই স্বপ্ন দেখল। তারা দুই ভাই হাত ধরে হাঁটছে আর গান গাইছে। এমন সময় রাস্তায় তাদের সামনে গাড়ি থেকে এক সাহেব নামল। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন । সে হাসি হৃদয় জুড়ানো। তিনি নরম কন্ঠে বললেন -

"এই নাও এই টাকাটুকু রাখ। আমি তোমাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। এটা রাখ নইলে আমি রাগ করব"

তারা সম্মোহনের মত হ্যাঁ সায় দিয়ে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ করলো একসাথে। তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। তারা হাঁটতে শুরু করল। অবাক হয়ে খেয়াল করলো তারা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক গরুর হাটের সামনে। সারি সারি করে রাখা হাজারো গরু বাঁধা। লাল, কালো, সাদা, লাল-সাদা, সাদা-কালো কত রকমের যে গরু আছে তার ইয়ত্তা নেই।

"জামিল কোন ধরনের গরু তোর পছন্দ রে"
"লালডা খুব মনে ধরছে,ভাইজান"
"আচ্ছা সেটাই হইবো ল"

তারা জামিলের পছন্দের সেই লাল গরুটার কাছে গেলো। গরু ব্যাপারী কেন জানি তাদের সালাম দিল। তারা কিছুটা খুশি, আনন্দ আর গর্ববোধ অনুভব করলো। গরু কিনে আসার সময় তারা মোবাইলে একটা সেলফিও তুলল। সমস্যা হল কুরবানীর দিন গরু জবাইয়ের সময় জামিল কিছুতেই গরু কুরবানী করতে দিবে না। ভাইজান অনেক বোঝালো কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না জামিলের জেদের সামনে। শেষমেষ তারা শুরু করল টানাটানি। সেই টানাটানিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল তাদের। ঘুম থেকে উঠে জামিলের মন খারাপ হয়ে গেলো। হঠাৎ ভাইজান একটা লাল রঙের গরু নিয়ে উপস্থিত। ডান হাতে গরুর দড়ি আর বাম হাতে একটা ক্যামেরা সম্ভবত ফাহিমদের।
"জামিল আই ভাই। চল একটা সেলফি উঠাই।আমাগো কি স্বাদ আল্লাদ নাই নাকি"
"খাড়াও আমি একখান জামা গায়ে দিয়া নিই"
"তাড়াতাড়ি কর। মালিক নামাজ পড়তে গেছে। গোসল করামু বইলা আনছি"
"হ তুলো আমি তৈয়ার"

ক্লিক করে শব্দ করে উঠে গেল গরুর সাথে তাদের ছবি যাকে সেলফি বলে ডিজিটাল যুগের মানুষ। এক নিরীহ প্রাণীর পাশে আরো দুটি প্রাণী দেখে কারো পার্থক্য করার ক্ষমতা নেই এ দুনিয়ায় যে তারা ভিন্ন। যেন তারা এক অভিন্ন কিছু অনন্য।

Comments

Popular Posts